অন্ধকার একটি ঘরের কোণায় টিমটিম আলোতে তিনটি প্রাণীকে দেখা যাচ্ছে একজন খাটের পাশেই বসে হেলান দিয়ে আধবুঁজা চোখ দিয়ে পাশের শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে, যে-কিনা অনেকক্ষণ পরপর একবার একটা বড় করে নিশ্বাস নিচ্ছে আর সেই সাথে সাথে যেন দমটা মুখ দিয়ে বের হবে হবে মনে হচ্ছে। অন্য পাশটায় একটা ক্লান্ত যুবক কাঁদা হয়ে ঘুমোচ্ছে, দেখলেই বুঝা যায় সকলের উপর দিয়ে ধকল গেছে। বাইরে মাইকের আওয়াজে দেশের গান হচ্ছে কিন্তু তিনজনের মধ্যে দু-জনেই প্রায় ঘুমে সম্পূর্ণ অচেতন। বাকি যে ব্যক্তিটি শুয়ে আছে সে জেগে আছে কি-না তা যেমন নিশ্চিত করে বলা যায় না তেমন আজকে রাতটা পার করতে পারবে কি-না তাও অনিশ্চিত।
রমজান আলী, বিছানায় এই মৃতপ্রায় মানুষটি। প্রায় সাতদিন যাবত এই একই চিত্র চলতে থাকায় আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী যা ছিল সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে, বাকি শুধু মৃত্যুটা। কেউ কেউ এসে দু-একদিন থেকে গেছে কিন্তু একই কান্না আর কতদিন করা যায়? তাই অফিস, স্কুল-কলেজ, ছেলে- মেয়েদের পড়ালেখা একেকজন একেক অজুহাতে চলে গেছে তবে যারা একান্তই যেতে পারে নাই তারা হল তার পাশের অর্ধ নিদ্রামগ্ন তার স্ত্রী এবং ছেলে। হয়তো একটা ব্যাপারে বিশেষ সুবিধা করতে না পারায় মনে হয় সকলেই মনক্ষুন্ন অর্থাৎ আজরাইল কে কিছু দিলে যদি তারিখটা আগানো যেত তাহলে তারা আর দেরি করতো না। শেষে সকলেই দেখতে এসে চলে যাবার সময় বলে গেল যে, 'কিছু একটা হলে কিন্তু অবশ্যই খবর দিও'। এই কিছু একটা যে মৃত্যু তা সম্ভবত বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপেলেও ধরতে পারবে।
রমজান আলী বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেশের গান শুনছেন আর অনেকক্ষণ পর পর খুব করে দম নিয়ে নিচ্ছেন। দেশ নিয়ে রমজান আলী'র নিজের যে শ্রদ্ধা বা সন্মান আছে তা-তে সকলেই দাগ ফেলতে চেষ্টা করছে, এইতো সেদিন নিজের স্ত্রী তাকে দেশ নিয়ে অনেক কথা শুনালেন, 'প্রতিদান নেবে না! কি কথার ছিরি। ভুল সার্টিফিকেট দিয়ে কত মানুষ মাসে মাসে ভাতা নিচ্ছে এমন কি জায়গাও নিচ্ছে আর উনি?' রমজান আলীর সেদিন কোন কথা বলার ছিল না কেবল মনে মনে ভাবছিল, প্রতিদান? সেটা তো সর্বক্ষণ-ই পায়। ঐ যে সেদিন টি.এস.সি'র সামনে কতগুলো ছোট ছোট বাচ্চাকে দেখেছিলো ঠিক পুতুলের মতো লাল পেঁড়ে শাড়ি আঁটসাঁট করে গায়ে জড়িয়ে হেলিতে-দুলিতে, উঠিতে-বসিতে, দেঁৗড়াইতে-খোঁড়াইতে এমনভাবে চলছিল যে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়, গালে দেশের পতাকা আঁকা, অন্যপাশে মহান বিজয় দিবস লিখা, হাতে একটা ছোট্ট একতারা। এর চেয়ে বড় কোন প্রতিদান হতে পারে কি?
ছেলেকে দেশ সমর্পকে জানানো আর তার মাঝে দেশপ্রেমটা জাগ্রত করার বিশেষ ইচ্ছাও রমজান আলীর ছিল আবার ছেলের ভিতর যে ছিল না তা তো নয়, শত হলেও এক রক্ত তো! অথচ সব যেন কেমন গোলমেলে হয়ে গেল, ছেলেটার ইচ্ছাছিল বাবার নাম যেন মুক্তির পাতায় ওঠে, তাহলে অভাবের সংসারে কিছু টাকা (ভাঁতা হিসেবে) পাওয়া যাবে অন্তত মাঁথা গুজার একটা ঠাঁই তো পাই। ছেলেটা সার্টিফিকেট নিয়ে খুব দৌঁড়-ঝাঁপ দিয়েছিল, রমজান যে না করবে সেই ক্ষমতাটাও তার ছিল না। একদিন রমজান শুয়ে শুয়ে আঁড়চোখে দেখেছিল ছেলেটা তার মায়ের কাছে আক্রোশের সাথে বলছিল, 'ছি! এরাও ঘুষ খায়?'
বিছানায় পরার পর রমজান এর চোখ, কান ও মুখ ছাড়া সবই প্রায় অচল, মনে হয় শরীরের এক একটা অংশের উপর বন্ধ হওয়ার অর্ডার দেয়া হচ্ছে আর অর্ডার অনুযায়ী কমান্ড আস্তে আস্তে কার্যকর হচ্ছে, যেমন প্রথমেই পা-টা গেল। রমজান গান শুনতে শুনতে দেশের প্রেক্ষাপটে নিজেকে কল্পনা করছিল আর অনেকক্ষণ পর পর একটা হা-করে মুখ ভরে দম নিয়ে নিচ্ছিল। দু-একদিন আগের কথা, অবস্থাটা মনে হয় বেশি-ই খারাপ হয়েছিল, কেবল কান দিয়ে সকলের শব্দ শোনা ছাড়া আর কিছুই পারে নি। কে যেন হঠাৎ বলেছিল, দেখ, মরে গেছে কি-না? রমজান সেদিন শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, মৃতু্যটা তো অনেক আগেই হয়ে গেছে তার, যেদিন এল.এম.জি টা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে এগোচ্ছিল ঠিক তখনই যখন কানের কাছে শীস দেয়ার মত একটা শব্দ পেল আর পিছনে আজিম ছেলেটা স্টেনগান হাতে পরে রইল, মনে হয় মাত্র এক ইঞ্চির জন্য। ওহ! আবার বড় করে হা-কওে মুখ ভর্তি বাতাস গিল্লো ।
রমজান এর বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ করছিল ঠিক ঢাকের শব্দের মত। যা মাইকের আওয়াজ ছাঁপিয়েও রমজান এর কানে লাগছিল আর মনে হচ্ছিল কালকে সকালের পূর্বে-ই বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বন্ধ হওয়ার জন্য উপর থেকে 'হাই কমান্ড' আসবে। বাইরে তখন ঐ গানটা হচ্ছিল, -
"হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না......"
তার চোখের থেকে একফোঁটা জল কান বেয়ে টুপ করে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো। হ্যা, ইতিহাসে তার সত্যিই কোন নাম লিখা থাকবে না, এমন কি মুক্তির পাতায়ও না। কিন্তু এ নিয়ে রমজান আলী'র একটুকুও কষ্ট নেই কেননা, 'দেশ আমাকে কি দিয়েছে?' এ প্রশ্নের উত্তর গুঁছিয়ে বলতে না পারলেও গর্বে যেন তখন বুকের পাটা-টা ফুলে উঠত সর্বদাই।
বাইরে মাইকে তখনো চলছিল-
"এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা,
আমরা তোমাদের ভুলব না.......... "
ঘরের ভিতর ঘড়ির কাটাটি টিক টিক করে বারোটায় পেঁৗছুলো কিন্তু হৃদপিন্ডের ঢিপ ঢিপ শব্দটা আর তার সাথে তাল মিলাতে পারলো না
২৬ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪